Followers

বশীকরণের ছয়টি মন্ত্র

মানুষকে বশে রাখার ছয়টি মন্ত্র আছে। খুবই কাজের, একেবারে অব্যর্থ। তবে বেশি উৎসাহী হবেন না। মন্ত্রগুলো আপনাদের জানা অবশ্য।

প্রথমে আসি, বশ করা মানে কী? কাউকে বশ করা মানে নিয়ন্ত্রণ করা। অর্থাৎ একজন স্বকীয়ভাবে যা করত, তা করতে না দেওয়া কিংবা যা করত না, তা করিয়ে নেওয়া। চিন্তাকেও বশ করা যায়। অনেক সময় যে বশীভূত, সে বুঝতে পারে না যে বশ হয়েছে।

ভালো কাজেও অন্যকে বশ করতে হয়, যেমন কাউকে দিয়ে জনসেবা করিয়ে নেওয়া। সেটাকে বশ করা বলা হয় না; বলা হয় অনুপ্রেরণা। মন্দ উদ্দেশ্যে বা নিজের লাভের জন্য অন্যকে প্রভাবিত করাকেই সাধারণভাবে বশীকরণ বলা হয়।

আমরা নিত্য বিভিন্নভাবে নিজের অজান্তে বশীভূত হচ্ছি। অফিসে, শপিংমলে, মিডিয়ার কাছে, সামাজিক জমায়েতে, এমনকি নিজ বাড়িতেও নিজের স্বকীয়তা কম-বেশি বিসর্জন দিচ্ছি। অথবা এমন হতে পারে আমিই অন্যকে অন্যায়ভাবে বশীভূত করছি। এটা সামান্য পচা মাছ গছিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে, একজনকে টেররিস্ট বানানো পর্যন্ত—অনেক কিছুই হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ একজন আপনাকে সারা জীবন ভাবাল যে, ‘মঈন সাহেব লোকটা খুবই পাজি।’ কিন্তু আসলে তিনি হয়তো ফেরেশতার মতো মানুষ। এর পেছনে বক্তার যখন একটা অসৎ উদ্দেশ্য থাকে, তখন তা বশীকরণ।

ইরান দেশটা কেমন, নর্থ কোরিয়া ও এর মানুষেরা কেমন, তা শুধু মিডিয়াই আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে। যে মিডিয়া আপনি দেখেন বা শোনেন, তা-ই আপনার চিন্তাকে কোনো না কোনোভাবে বশীভূত করছে। তবে আজকের বশীকরণের আলোচনা মিডিয়া নিয়ে নয়। আজকের আলোচনা ব্যক্তি মানুষ নিয়ে।

এখন দেখা যাক যে ছয় মন্ত্রের কথা বলা হলো, তা আসলে কী। ছয় মন্ত্রের প্রথমেই আসে ‘রাগ’। এর পর যথাক্রমে অভিমান, কথার প্যাঁচ, ক্ষমতা, উৎকোচ ও গুণ। হয়তো ইতিমধ্যেই বুঝে ফেলেছেন এসব মন্ত্রে আসলেই যে কাজ হয়। তবু বিশ্লেষণে যাই।

রাগ

আপনি যদি খুব রাগতে পারেন, রেগে যদি কাণ্ড করে বসেন, বা নাও বসেন, তাহলে মানুষ আপনি রেগে যাবেন ভেবে তার যা করার কথা ছিল তা করবে না। অর্থাৎ বেশ কিছুটা বশ করা যাচ্ছে। এই বশ হওয়ার নানাবিধ কারণ আছে। একেবারে রেগে খুন করে ফেলবে থেকে শুরু করে, রাগলে তার নিজেরই না ব্লাড প্রেশার বেড়ে হার্ট অ্যাটাক করে বসে পর্যন্ত আশঙ্কাগুলো সাবজেক্টকে রাগী লোকটার কথা শুনতে বাধ্য করে। মানে বশে রাখে। এ জন্য আমাদের কমিউনিটিতে মানুষের রাগী হওয়ার একটা প্রবণতা আছে। মন্দ বিষয় হলেও অনেকে এটি নিয়ে গর্ব করেন।

অভিমান

অভিমানকে দুর্বলের অস্ত্র বলা হলেও এটিই বেশি কাজের। প্রেস ক্লাবের সামনে গিয়ে অনশন করলেন—এটা হলো অভিমান। তাতে একটু হলেও টনক নড়বে। অথবা ঘরের দরজা লাগিয়ে দিয়ে ছোট মেয়েটা না খেয়ে শুয়ে থাকল, ডাকলেও দরজা খোলে না। ফলাফল? যা চাইছিল তাই দেওয়ার অন্তত একটি প্রতিশ্রুতি আদায়। অর্থাৎ এ অস্ত্রটিও অন্যকে বশ করতে বেশ কাজে লাগে।

কথার প্যাঁচ

এটি খুবই কার্যকর মন্ত্র। এই অস্ত্র অবশ্য সবার থাকে না। ‘ইউজড কার সেলস ম্যান’-তারা কথার মারপ্যাঁচে আপনাকে যা চাননি তা-ই বেশি দামে কিনিয়ে ছাড়বে। এক সেলসম্যানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ব্যাকআপ ক্যামেরা চাই। এই গাড়িতে তো ব্যাকআপ ক্যামেরা নাই?’ সে বলল, ‘ব্যাকআপ ক্যামেরা কোনো কাজের না। ওটা থাকার পরও আমি গাড়ি ব্যাক করতে গিয়ে মেইল বক্সে লাগিয়ে দিয়েছি।’ কাজেই ব্যাকআপ ক্যামেরা ছাড়াই তার গাড়ি কিনলাম। অনেক পরে ব্যাকআপ ক্যামেরা ব্যবহার করে খুবই চমৎকৃত হয়েছি। কাজের একটা জিনিস বটে। সেই সেলসম্যান আমাকে গাড়ি গছিয়ে দেওয়ার জন্য কথায় বশীভূত করেছিল।

কথার কয়েকটা মোক্ষম প্যাঁচ আছে। একটা হলো, মানুষের মধ্যে অপরাধবোধ সৃষ্টি করা। সামান্য কথা, ‘আপনি মনে হয় আমাকে অপছন্দ করেন।’ এটা মোক্ষম। ‘সেন্স অব গিল্ট’ তৈরি করতেই এমন বাক্য ব্যবহার করা হয়। আবার আছে আঁতে ঘা লাগানো। ‘তোমার দ্বারা এ কাজ কিছুতেই হবে না’, ধরনের কথা ইগোতে লাগে। যাকে বলা হলো সে জানপ্রাণ দিয়ে কাজটি সমাধা করবে। অবশ্য এটা একটা সাধারণ মন্তব্যও হতে পারে। নির্ভর করছে বক্তার উদ্দেশ্য কী তার ওপর।

ক্ষমতা

কে না জানে যে ক্ষমতা খুব কাজের জিনিস। শুধু ক্ষমতা আছে বলেই কেউ একজন আপনার কথা শুনছে, বা আপনার বশে আছে। সেই ক্ষমতা আপনি তার ওপর প্রয়োগ করেননি, অথবা কোনো দিন করবেনও না জেনেও ক্ষমতা দেখলেই সালাম করার একটি সহজাত প্রবৃত্তি বেশির ভাগ মানুষের মধ্যেই আছে।

উৎকোচ

এর দ্বারা অন্যের কাছ থেকে কাজ আদায় করা যায়, বশেও রাখা যায়। উৎকোচ শুধু টাকা নয়। ধরুন একটি মেয়ে একটি ছেলের সামনে কারণে-অকারণে হাসছে, উচ্ছলতা দেখাচ্ছে। সে কিছু একটা আদায় করতে চায়। রশীদ করিম লিখেছেন যে, ‘একটি মেয়ে কাপড় কিনতে গেলেও দোকানদারের সঙ্গে সামান্য লাস্য খরচ করে।’ (হুবহু নয়)

এই লাস্যও উৎকোচের পর্যায়ে পড়ে। লাস্য খরচ করে অন্যকে বশ করা যায়। খাওয়ার পরে কারও রান্নার ভূয়সী প্রশংসা করাও এক ধরনের উৎকোচ, তবে এতে দোষের কিছু নেই।

গুণ

একজন খুবই ভালো খেলোয়াড়, মানুষ তার ফ্যান হয়ে গেল। সে যা বলে, যা বোঝায়, অন্যরাও তা-ই বোঝে ও করে। সে এটাকে তার লাভের জন্য ব্যবহার করলে সেটা হবে বশ করা।

মোটাদাগে এই হলো ছয়টি বশীকরণ মন্ত্র ও এর কাজের পদ্ধতি। এখানে লক্ষণীয় যে, আমাদের অনেকগুলো ব্যক্তিগত আবেগ অন্যকে বশ করার কাজে লাগছে। এদের উৎপত্তিই হয়েছে অন্যকে বশ করার জন্য। যেমন নির্জন দ্বীপে কাউকে পাঠিয়ে দিলে অনেক দিন পর সে অভিমান ব্যাপারটা ভুলে যাবে। যেখানে অভিমানের কোনো ফল নেই, প্রকৃতি সেখান থেকে অভিমান নামের আবেগটি তুলে নেবে। অরণ্যে রোদন বলে তো একটা বাগধারাই আছে।

মানুষের নিঃসঙ্গতার আবেগটি তৈরি হয়েছে অনেক আগে। মানুষ একা বাস করতে গিয়ে যেন বিপদে না পড়ে, বিলীন না হয়ে যায় সে জন্যই এর সৃষ্টি। নিঃসঙ্গতা আছে বলেই মানুষকে বলা হয় সামাজিক জীব। বাঘ সামাজিক জীব নয়; কারণ, সে একা থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে সামাজিকের উল্টোটা কিন্তু অসামাজিক নয়; সেটা হবে, একা বাস করতে পারা।

যা হোক, উপরিউক্ত মন্ত্রগুলো অন্যের ওপর শুধু সৎ উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা উচিত। মানুষকে অসৎ উদ্দেশ্যে বশ করা মানে শৃঙ্খল ছাড়াই তাকে দাস বানিয়ে রাখা। আবার অন্যরা আপনার ওপর এসব প্রয়োগ করছে কিনা, সে বিষয়েও সজাগ থাকতে হবে। অসৎ উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত এমন মন্ত্রের কবলে পড়ে এমনকি পরাধীন জীবনও কাটাতে হতে পারে।

তবে সবকিছুই বশীকরণ নয়। একজন কৌশলে কথা বলতে পারে, কেউ একটুতেই রাগ/অভিমান করতেই পারে। উদ্দেশ্যটা অসৎ হলেই সমস্যা; না হলে এগুলো দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ মাত্র।

পরিশিষ্ট: এগুলোতে কাজ না হলে বশীকরণের এই অব্যর্থ মন্ত্রটি অমাবস্যার রাতে ১০০৮ বার পড়বেন।


মন্ত্র: —ওঁম কঙ্কালী মহাকালী, কেলি কলা ভ্যাঙ্গ স্বাহা।


দ্রষ্টব্য: কাজের পূর্বে অবশ্যই গুরুর অনুমতি নিয়ে কাজে হাত দিবেন, ডিসক্লেইমার না দিয়ে পারা গেল না।